নিউজ ডেস্ক: ভারতের গাড়ির ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে যেগুলো কেবলমাত্র একটি গাড়িকে নির্দেশ করে না, বরং একটি যুগ, একটি জীবনধারা, এবং একটি সামাজিক পরিচয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে। টাটা সুমো নিঃসন্দেহে তার মধ্যে অন্যতম। ১৯৯৪ সালে প্রথম আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে টাটা সুমো ভারতীয় সড়কে শুধু একটি গাড়ি ছিল না, বরং এটি হয়ে উঠেছিল ভারতীয় পরিবারের স্বপ্নের অংশ, সেনাবাহিনী ও সরকারি দফতরের নির্ভরযোগ্য যান, আর গ্রামীণ ও পাহাড়ি রাস্তায় মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গী। বহু বছর ধরে এর শক্তিশালী গঠন, প্রশস্ত কেবিন, এবং সাশ্রয়ী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এটি গ্রাহকদের হৃদয়ে বিশেষ স্থান করে নিয়েছিল। তবে সময়ের সাথে সাথে প্রতিযোগিতা বেড়েছে, নতুন ডিজাইনের আধুনিক এসইউভি বাজার দখল করেছে, আর ধীরে ধীরে পুরনো সুমো প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল।\
কিন্তু ২০২৫ সালে টাটা মোটরস নতুন এক বিস্ময় নিয়ে হাজির হচ্ছে। তারা ঘোষণা করেছে নতুন টাটা সুমো এসইউভি ২০২৫, যা একদিকে আগের প্রজন্মের নস্টালজিয়া ফিরিয়ে আনবে, অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের চাহিদার সাথে মানিয়ে নেবে। এটি কেবলমাত্র একটি গাড়ির পুনর্জন্ম নয়, বরং ভারতীয় এসইউভি বাজারে এক সাহসী প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা। নতুন সুমো আগের মতোই শক্তিশালী, তবে এবার আরও বেশি আধুনিক, আরও স্টাইলিশ, এবং অবিশ্বাস্যরকম বাজেট-ফ্রেন্ডলি।
এই নতুন সুমোর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এর ২৯৫৬ সিসি টার্বোচার্জড ডিজেল ইঞ্জিন, যা শুধু শক্তিশালী পারফরম্যান্সই দেবে না, বরং দেবে এক অভাবনীয় জ্বালানি সাশ্রয়—প্রতি লিটারে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার মাইলেজ। ভারতীয় বাজারে যেখানে জ্বালানির দাম ক্রমাগত বাড়ছে, সেখানে এত বড় ইঞ্জিনের একটি এসইউভি থেকে এই রকম সাশ্রয়ী মাইলেজ পাওয়া সত্যিই এক বিপ্লব। ফলে শহরের ভিড়ভাট্টা থেকে শুরু করে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা বা গ্রামীণ কাঁচা পথ—যেখানেই চলুক না কেন, এই গাড়ি দেবে একইসাথে শক্তি ও সাশ্রয়ের নিশ্চয়তা।
নতুন সুমোর বাহ্যিক নকশা একেবারে আধুনিক ধাঁচের। এর চওড়া ও মাংসল বডি একে দারুণ রোড-প্রেজেন্স দিয়েছে। উঁচু গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স, আক্রমণাত্মক ফ্রন্ট গ্রিল, এবং স্টাইলিশ ডুয়াল-টোন অ্যালয় হুইল এটিকে সাধারণ এসইউভির ভিড় থেকে আলাদা করে তুলেছে। এলইডি হেডল্যাম্প ও রুফ রেলস একে শুধু আভিজাত্যই দেয়নি, বরং অফ-রোড অভিযানের জন্যও উপযোগী করে তুলেছে। টাটা মোটরস চেষ্টা করেছে ইউটিলিটি এবং মডার্ন ডিজাইনের মধ্যে এক ভারসাম্য তৈরি করতে, যাতে পরিবার, ভ্রমণপিপাসু কিংবা ব্যবসায়িক ব্যবহারকারীরা সবাই সমানভাবে আকৃষ্ট হন।
গাড়ির ভেতরের দিকেও এসেছে এক বিরাট পরিবর্তন। পুরনো দিনের সাধারণ কেবিন এখন একেবারে আধুনিক ও প্রিমিয়াম রূপ নিয়েছে। প্রশস্ত কেবিনে ৭ থেকে ৮ জন যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যে বসতে পারবেন। যাত্রাপথে ক্লান্তি কমাতে সিটের নকশা আরও আরামদায়ক করা হয়েছে। ভেতরে রয়েছে ১০ ইঞ্চির টাচস্ক্রিন ইনফোটেইনমেন্ট সিস্টেম, যেখানে আছে অ্যান্ড্রয়েড অটো ও অ্যাপল কারপ্লে সাপোর্ট। এছাড়া আছে ক্রুজ কন্ট্রোল, অটোমেটিক ক্লাইমেট কন্ট্রোল, ইউএসবি চার্জিং পোর্ট প্রতিটি সারিতে, এবং পাওয়ার উইন্ডো। ফলে দীর্ঘ যাত্রাও হবে আরামদায়ক ও উপভোগ্য।
নিরাপত্তার দিকেও কোনো খামতি রাখেনি টাটা। এবিএস সহ ইবিডি, ডুয়াল এয়ারব্যাগ, রিয়ার পার্কিং সেন্সর—সবকিছুই এই সেগমেন্টের মধ্যে অন্যতম সেরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ফলে পরিবার নিয়ে দীর্ঘ দূরত্বের ভ্রমণ বা দুর্গম পাহাড়ি যাত্রাতেও থাকবে নিশ্চিন্ত সুরক্ষা।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো দাম। টাটা মোটরস সবসময় ভারতীয় গ্রাহকের বাজেটের কথা মাথায় রেখেছে। নতুন সুমোর এক্স-শোরুম দাম শুরু হতে পারে মাত্র ৮.৪৯ লাখ টাকা থেকে, যা একে সত্যিই এক অনন্যসাধারণ ডিল করে তুলেছে। শুধু তাই নয়, মাসিক ইএমআই অপশন শুরু হচ্ছে প্রায় ৮,০০০ টাকা থেকে, ফলে মধ্যবিত্ত ক্রেতার কাছেও এটি এক বাস্তবসম্মত বিকল্প হয়ে উঠছে। ব্যক্তিগত ব্যবহার থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক ট্যাক্সি বা ফ্লিট অপারেটরদের জন্যও এটি হতে পারে সেরা পছন্দ।
তবে নতুন সুমোর গুরুত্ব শুধু গাড়ির সীমাবদ্ধতায় আটকে নেই। এর প্রত্যাবর্তন ভারতীয় গাড়ি সংস্কৃতির মধ্যেও এক নতুন প্রাণ সঞ্চার করবে। যারা নব্বই বা দুই হাজার দশকের প্রথম দিকে বড় হয়েছেন, তাদের কাছে সুমো মানেই ছিল মজবুত ও ভরসাযোগ্য এক যানবাহন। আজকের প্রজন্ম সেই একই সুমোকে আরও আধুনিক রূপে দেখতে পাবে—যা একইসাথে অতীতের আবেগ ও বর্তমানের প্রযুক্তিকে একত্র করেছে।
ভারতীয় বাজারে যেখানে বাজেট ফ্রেন্ডলি কিন্তু শক্তিশালী এসইউভির চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে, সেখানে নতুন সুমো নিঃসন্দেহে এক শক্তিশালী প্রতিযোগী হবে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সংস্থা যেমন মাহিন্দ্রা বোলেরো, মারুতি এরটিগা বা হুন্ডাইয়ের এন্ট্রি-লেভেল এসইউভি মডেলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। কিন্তু সুমোর নাম, তার ঐতিহ্য, এবং এই অবিশ্বাস্য মাইলেজ একে বাকিদের থেকে আলাদা জায়গায় নিয়ে যাবে।
অন্যদিকে, বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্যও সুমো সবসময়ই ছিল প্রথম সারির পছন্দ। গ্রামীণ এলাকায় স্কুলগাড়ি, অফিস বাস, এমনকি দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহণেও এটি বহু বছর ধরে ব্যবহৃত হয়েছে। নতুন মডেল আসার পর বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও এর চাহিদা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ কম খরচে বেশি সিটিং ক্যাপাসিটি ও উচ্চ মাইলেজ—এই দুটি দিক ফ্লিট মালিকদের কাছে সবসময়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সবকিছু বিচার করলে বলা যায়, নতুন টাটা সুমো এসইউভি ২০২৫ শুধু একটি গাড়ি নয়, বরং এটি ভারতের এসইউভি বাজারের এক নতুন অধ্যায়। এটি একদিকে অতীতকে সম্মান জানাচ্ছে, অন্যদিকে ভবিষ্যতের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। শক্তি, সাশ্রয়, আরাম, এবং আধুনিকতার এক অনন্য সমন্বয় করে টাটা মোটরস আবারও প্রমাণ করেছে কেন তারা ভারতীয় অটোমোবাইল জগতের শীর্ষে রয়েছে।
শেষ পর্যন্ত বলা যায়, নতুন সুমো ভারতীয় চালকদের সেই পুরনো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনবে। শহরের ব্যস্ত সড়ক থেকে শুরু করে গ্রাম্য কাঁচা রাস্তা কিংবা পাহাড়ি অভিযান—যেখানেই যাত্রা হোক না কেন, নতুন সুমো দেবে শক্তি, নিরাপত্তা, আরামের এক সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা। এটি শুধু একটি গাড়ি নয়, বরং ভারতীয় চালকের গর্বের প্রতীক হয়ে উঠবে। টাটা মোটরসের এই সাহসী পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে ভারতীয় গাড়ি শিল্পকে আবারও নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে।