BitChat: ইন্টারনেট ছাড়াই যোগাযোগের নতুন দিগন্ত খুলছে জ্যাক ডরসির ‘বিটচ্যাট’!

NEWS DESK – বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি দুনিয়ায় গোপনীয়তা এবং নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে টুইটারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসি নিয়ে এসেছেন যুগান্তকারী এক মেসেজিং অ্যাপ ‘বিটচ্যাট’। অ্যাপল অ্যাপ স্টোরে মুক্তি পাওয়া এই অ্যাপটি ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়াই ব্যবহারকারীদের মধ্যে বার্তা আদানপ্রদানের সুযোগ দিচ্ছে। এটি শুধু হোয়াটসঅ্যাপের একটি বিকল্প নয়, বরং জরুরি পরিস্থিতি বা সীমিত নেটওয়ার্ক এলাকায় যোগাযোগের জন্য একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এর প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বিটচ্যাট বর্তমানে সীমিত পরিসরে ব্যবহৃত হলেও এর প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা বিস্ময়কর এবং ভবিষ্যতে এটি বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের ধরন পাল্টে দিতে সক্ষম হতে পারে।

বিটচ্যাটের অন্যতম বিশেষত্ব হলো এর প্রযুক্তি। সাধারণত ব্লুটুথ সিগন্যাল সর্বাধিক ১০০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত কার্যকর থাকে। কিন্তু বিটচ্যাট এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করার জন্য ব্যবহার করছে মেশ নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি এমনভাবে কাজ করে যে একটি বার্তা আশেপাশের অন্যান্য ব্যবহারকারীদের ডিভাইসের মাধ্যমে রিলে হয়ে ধাপে ধাপে দূরবর্তী ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে যায়। এর ফলে ব্যবহারকারীরা সরাসরি ব্লুটুথ সংযোগ ছাড়াই অনেক দূরত্বে থাকা ব্যক্তির কাছে বার্তা পাঠাতে পারেন। মজার বিষয় হলো, জ্যাক ডরসি নিজেই জানিয়েছেন যে মাত্র এক ছুটির দিন ব্যয় করেই তিনি অ্যাপটি তৈরি করেছেন। তবুও এর নকশা এতটাই শক্তিশালী এবং নিরাপদ যে এটি কোনো কেন্দ্রীয় সার্ভার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর নির্ভর করে না।

এই অ্যাপ ব্যবহারের জন্য কোনো ইমেইল ঠিকানা বা ফোন নম্বরের প্রয়োজন নেই। এটি ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বর্তমানে প্রচলিত মেসেজিং অ্যাপগুলোতে ব্যবহারকারীদের নাম, নম্বর বা অন্যান্য তথ্য সংরক্ষিত থাকে, যা অনেক সময়ই নজরদারি বা ডেটা চুরির ঝুঁকিতে পড়ে। বিটচ্যাট সেই ঝুঁকি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলার জন্য তৈরি। এটি এমন এক প্ল্যাটফর্ম যেখানে ব্যবহারকারীরা গোপনীয়তা বজায় রেখেই নিরাপদভাবে বার্তা পাঠাতে ও পেতে পারেন।

Telegram Join

বিটচ্যাটের শ্বেতপত্রেও এই দর্শন স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, “বিটচ্যাট তৈরি হয়েছে এমন এক দৃঢ় ও ব্যক্তিগত যোগাযোগের প্রয়োজন মেটাতে, যা কোনো কেন্দ্রীভূত অবকাঠামোর ওপর নির্ভর করবে না।” অ্যাপটি ব্লুটুথ লো এনার্জি মেশ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে। এর ফলে কাছাকাছি থাকা ব্যবহারকারীদের মধ্যে সরাসরি পিয়ার-টু-পিয়ার মেসেজ আদানপ্রদান সম্ভব হয় এবং বার্তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আশেপাশের অন্যান্য ব্যবহারকারীদের মাধ্যমে গন্তব্যে পৌঁছে যায়। এর ফলে সীমিত ব্লুটুথ পরিসর অতিক্রম করে দূরবর্তী ব্যবহারকারীদের সঙ্গেও যোগাযোগ সম্ভব হয়।

প্রচলিত নেটওয়ার্ক ব্যর্থ হলে বা অতিরিক্ত লোডের কারণে ধীর হয়ে গেলে বিটচ্যাট হবে অত্যন্ত কার্যকর একটি মাধ্যম। বড় মাপের জনসমাগমপূর্ণ অনুষ্ঠান যেমন কনসার্ট, উৎসব বা খেলাধুলার ম্যাচের সময় মোবাইল নেটওয়ার্ক সচরাচর অকেজো হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে বিটচ্যাট ব্যবহারকারীদের নিরবচ্ছিন্নভাবে যোগাযোগের সুযোগ করে দিতে পারে। ইতোমধ্যেই কিছু ব্যবহারকারী এই অ্যাপের কার্যকারিতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। উদ্যোক্তা দিমিত্রিওস পাওলো উল্লেখ করেছেন, তিনি বিমানের দুই প্রান্তে বসে থাকা অবস্থায় তার ভাইয়ের সঙ্গে বিটচ্যাট ব্যবহার করে বার্তা আদানপ্রদান করতে সক্ষম হয়েছেন। এটি প্রমাণ করে যে ইন্টারনেটবিহীন অবস্থায়ও এই প্রযুক্তি নির্ভরযোগ্যভাবে কাজ করতে পারে।

বিটচ্যাটের বিকেন্দ্রীভূত কাঠামো এটিকে আরও শক্তিশালী ও সেন্সরশিপ প্রতিরোধী করে তুলেছে। অনেক দেশে সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট নিষেধাজ্ঞা বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। বিটচ্যাট সেই নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত। জ্যাক ডরসি বলেছেন, “এই অ্যাপটির নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যে কোনো দেশের রাষ্ট্রীয় ইন্টারনেট নিষেধাজ্ঞার প্রভাব এর ওপর পড়বে না।” এর ফলে এটি বিক্ষোভ, প্রতিবাদ বা অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনের সময় সেন্সরশিপ-বিরোধী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বিকেন্দ্রীভূত প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম ‘লোগোস নেটওয়ার্ক’-এর প্রতিষ্ঠাতা জ্যারাড হোপ বিটচ্যাটের গুরুত্ব সম্পর্কে মত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “বিভিন্ন বিকেন্দ্রীভূত নেটওয়ার্ক আমাদের এমন এক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে গোপনীয়তা নিজে থেকেই যোগাযোগের একটি মৌলিক অংশ হয়ে উঠবে।” তার মতে, যদি মানবাধিকার ডিজিটাল দুনিয়ায় যথাযথভাবে প্রয়োগ না হয় এবং ইন্টারনেট অবকাঠামো সরকার বা বড় কোম্পানির নজরদারির হাতিয়ারে পরিণত হয়, তবে বিটচ্যাটের মতো ব্লুটুথ মেশ নেটওয়ার্ক অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ এই অ্যাপ কোনো কোম্পানির প্রতিশ্রুতি বা নিয়ন্ত্রকের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং এটি নিজস্ব নেটওয়ার্ক কাঠামোর মাধ্যমে ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা রক্ষা করে।

বিশ্বের প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের জন্য বিটচ্যাট এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। একদিকে যেখানে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ করে বিপুল ব্যবসা গড়ে তুলছে, সেখানে বিটচ্যাটের মতো একটি প্ল্যাটফর্ম মানুষের গোপনীয়তা রক্ষার দিকটি সামনে নিয়ে এসেছে। এটি শুধু বার্তা আদানপ্রদানের একটি মাধ্যম নয়, বরং বিকেন্দ্রীভূত যোগাযোগ প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে তার একটি বাস্তব উদাহরণ।

আজকের পৃথিবীতে যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীলতা এতটাই বেশি যে নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হলে মানুষ বিপাকে পড়ে যায়। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বা রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় প্রচলিত যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যর্থ হলে বড় ধরনের মানবিক সংকট তৈরি হয়। বিটচ্যাট এই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে। ব্যবহারকারীদের ডিভাইসের মাধ্যমেই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা থাকায় এটি এমন এলাকায়ও কার্যকর হতে পারে যেখানে ইন্টারনেট বা মোবাইল নেটওয়ার্কের কোনো অবকাঠামো নেই।

জ্যাক ডরসি তার নতুন এই উদ্ভাবনের মাধ্যমে প্রযুক্তি দুনিয়ায় আবারও গোপনীয়তা ও স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। বিটচ্যাট নিঃসন্দেহে এমন এক অ্যাপ যা যোগাযোগের ভবিষ্যৎকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করবে। এর সহজ ব্যবহার, নিরাপদ কাঠামো এবং বিকেন্দ্রীভূত নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীদের এমন এক অভিজ্ঞতা দেবে যা প্রচলিত মেসেজিং প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে তুলনাহীন। ভবিষ্যতে যদি এটি আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তবে তা শুধু প্রযুক্তির অগ্রগতির দিকেই নয়, ব্যবহারকারীর অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রেও এক বড় পদক্ষেপ হবে।

বিটচ্যাটের সাফল্য প্রমাণ করবে যে গোপনীয়তা ও প্রযুক্তি একসঙ্গে চলতে পারে এবং ব্যবহারকারীর নিয়ন্ত্রণেই যোগাযোগের ক্ষমতা থাকা উচিত। এমন এক সময়ে যখন ডিজিটাল দুনিয়া ক্রমশ নজরদারিমূলক হয়ে উঠছে, তখন বিটচ্যাট ব্যবহারকারীদের জন্য স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার নতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছে। ইন্টারনেট ছাড়াই নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের সুযোগ করে দেওয়া এই অ্যাপটি নিঃসন্দেহে আগামী দিনের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী, মানবিক এবং ব্যবহারকারী-কেন্দ্রিক করে তুলবে।

Whatsapp Join

Leave a Comment

Join Our WhatsApp Group!