নিউজ ডেস্ক: প্রযুক্তি দুনিয়ায় এক চাঞ্চল্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ভিত্তিক স্টার্টআপ পারপ্লেক্সিটি। সংস্থাটি সরাসরি বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়েব ব্রাউজার গুগল ক্রোম কেনার প্রস্তাব দিয়েছে, যা প্রযুক্তি শিল্পে এক বড় আলোড়ন তুলেছে। ব্লুমবার্গের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরবিন্দ শ্রীনিবাসের নেতৃত্বাধীন এই কোম্পানি গুগলের কাছে ক্রোম ব্রাউজার কেনার জন্য ৩৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৩.০২ লাখ কোটি টাকা) অফার করেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই প্রস্তাবিত অর্থের পরিমাণ পারপ্লেক্সিটির নিজের বাজারমূল্যের চেয়েও বেশি।
এই প্রস্তাব এমন এক সময়ে এসেছে যখন গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট সম্প্রতি একটি অ্যান্টি-ট্রাস্ট মামলায় পরাজিত হয়েছে। মার্কিন বিচার বিভাগ গুগলকে সার্চ ইঞ্জিনের বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত করে মামলা করেছিল। আদালত রায় দেয় যে গুগল অ্যাপলসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে প্রতিযোগিতাবিরোধী চুক্তি করেছে, যাতে গুগল সার্চ ইঞ্জিনকে ব্যবহারকারীদের সামনে প্রাধান্য দেওয়া যায়। এই রায়ের পর গুগলের ওপর ব্রাউজার বিক্রির চাপ বাড়ছে। মার্কিন সরকারও গুগলকে ক্রোম ব্রাউজার বিক্রি করার পাশাপাশি সার্চ ডেটা প্রতিযোগীদের লাইসেন্স দেওয়া এবং অন্যান্য ডিভাইস ও পরিষেবায় একচেটিয়া প্রচারের জন্য অর্থ প্রদান বন্ধ করার দাবি তুলেছে।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পারপ্লেক্সিটি এই বিশাল কেনাকাটার জন্য বাইরের বিনিয়োগকারীদের সহায়তা নিতে চায়। কোম্পানির চিফ বিজনেস অফিসার দিমিত্রি শেভেলেনকো বলেন, “বহু বড় বিনিয়োগ তহবিল এই লেনদেনের সম্পূর্ণ অর্থায়নে সম্মতি দিয়েছে।” জুলাই মাসে পারপ্লেক্সিটি সর্বশেষ তহবিল সংগ্রহ পর্বে ১০০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৮৭৫ কোটি টাকা) নতুন মূলধন তুলেছিল, যার পর কোম্পানির বাজারমূল্য দাঁড়ায় ১৮ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ১.৫৭ লাখ কোটি টাকা)। ফলে, এবার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা কোম্পানির বর্তমান মূল্যায়নের প্রায় দ্বিগুণ।
টেকক্রাঞ্চকে দেওয়া এক বিবৃতিতে পারপ্লেক্সিটি প্রস্তাবটি প্রায় নিশ্চিত করেছে। কোম্পানি জানিয়েছে, তাদের অফারের অংশ হিসেবে ক্রোমের মূল ইঞ্জিন ক্রোমিয়াম ওপেন সোর্স হিসেবেই রাখা হবে এবং প্রতি বছর প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা) বিনিয়োগ অব্যাহত থাকবে। শুধু তাই নয়, সফলভাবে ব্রাউজার কিনে নিলেও ব্যবহারকারীদের ডিফল্ট সেটিংসে কোনো পরিবর্তন আনা হবে না। অর্থাৎ, গুগল সার্চ ইঞ্জিনই ক্রোমে ডিফল্ট সার্চ হিসেবে থাকবে, পারপ্লেক্সিটির নিজস্ব এআই-চালিত সার্চকে ডিফল্ট করা হবে না।
এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে—গুগল আদৌ কি ক্রোম বিক্রি করতে চাইবে? গুগল ক্রোম বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ব্রাউজার, যার ব্যবহারকারী সংখ্যা শত কোটি। এটি শুধু একটি পণ্য নয়, বরং গুগলের সার্চ ইঞ্জিন ও অন্যান্য পরিষেবার জন্য একটি বিশাল প্রবেশদ্বার। ক্রোম বিক্রি করলে গুগল শুধু প্রযুক্তিগত নয়, আর্থিকভাবেও বড় ধাক্কা খাবে। তবে অ্যান্টি-ট্রাস্ট মামলার রায়ের ফলে গুগলের ওপর চাপ অনেক বেড়েছে, এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির সিদ্ধান্তের ওপরই ভবিষ্যত নির্ভর করছে।
পারপ্লেক্সিটির সাহসী পদক্ষেপ অনেকের কাছেই অবাক করার মতো হলেও, এআই বাজারে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নতুন কিছু নয়। সংস্থাটির ইতিমধ্যেই একটি নিজস্ব ব্রাউজার রয়েছে, যার নাম Comet। এই ব্রাউজারটিতে এআই এজেন্ট যুক্ত রয়েছে, যা ব্যবহারকারীর হয়ে বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করতে পারে। কোম্পানি দাবি করেছে, এক সপ্তাহের কাজ মাত্র একটি প্রম্পট দিয়েই সম্পন্ন করা সম্ভব এই প্রযুক্তির মাধ্যমে। এমনকি তারা এমনও বলেছে যে, এর ফলে ভবিষ্যতে রিক্রুটার বা নিয়োগকর্তার প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে কমে যেতে পারে।
পূর্ববর্তী এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, পারপ্লেক্সিটি ২০২৬ সালের মধ্যে তাদের এআই-চালিত ব্রাউজার কমেটের ব্যবহারকারী সংখ্যা “দশ মিলিয়ন থেকে কয়েক শত মিলিয়ন” পর্যায়ে পৌঁছাতে চায়। এজন্য তারা স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলির (OEMs) সঙ্গে আলোচনায় রয়েছে, যাতে নতুন ডিভাইসগুলোতে ব্রাউজারটি প্রি-লোড করা যায়। এটি সফল হলে তারা সরাসরি বিপুল সংখ্যক ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে যাবে।
পারপ্লেক্সিটির প্রস্তাবে ক্রোমিয়ামের ওপেন সোর্স স্বত্ব বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি প্রযুক্তি মহলে ইতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে। কারণ, ক্রোমিয়াম শুধু ক্রোম নয়, বরং মাইক্রোসফট এজ, ব্রেভ, অপেরা সহ অনেক জনপ্রিয় ব্রাউজারের মূল ইঞ্জিন। ওপেন সোর্স হিসেবে এটি রয়ে গেলে বৈশ্বিক ডেভেলপার কমিউনিটি এবং প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি এর সুবিধা অব্যাহতভাবে পাবে।
যদিও অর্থনৈতিক দিক থেকে এই চুক্তি অনেক জটিল। $৩৪.৫ বিলিয়ন ডলারের মতো বিশাল অঙ্কের লেনদেন, যা একটি স্টার্টআপের জন্য বিরল এবং অভূতপূর্ব। পারপ্লেক্সিটি এই অর্থ বিনিয়োগকারীদের থেকে তুলতে পারলেও, ক্রোম কেনা এবং সফলভাবে পরিচালনা করা এক বিশাল দায়িত্ব হবে। ক্রোম কেবল একটি ব্রাউজার নয়, বরং এটি গুগলের একটি কৌশলগত সম্পদ, যা সার্চ, বিজ্ঞাপন এবং ডেটা সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি পারপ্লেক্সিটি কোনোভাবে ক্রোম অধিগ্রহণে সফল হয়, তবে এটি ইন্টারনেট ইকোসিস্টেমে এক বড় পরিবর্তন আনতে পারে। গুগল সার্চের ডিফল্ট অবস্থা বজায় থাকলেও, পারপ্লেক্সিটি ধীরে ধীরে তাদের নিজস্ব এআই প্রযুক্তি এবং পরিষেবা যুক্ত করে ক্রোমের অভিজ্ঞতায় পরিবর্তন আনতে পারে। এর ফলে প্রতিযোগিতার নতুন ধারা তৈরি হতে পারে, যা গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যাপলসহ অন্যান্য প্রযুক্তি জায়ান্টদের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ হবে।
সব মিলিয়ে, পারপ্লেক্সিটির এই প্রস্তাব প্রযুক্তি জগতে এক বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, এটি শুধু একটি আর্থিক লেনদেনের প্রস্তাব নয়, বরং বর্তমান ইন্টারনেট শাসন কাঠামোয় পরিবর্তন আনার এক প্রচেষ্টা। গুগল ক্রোম বিক্রি করবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—যদি এই অধিগ্রহণ বাস্তবায়িত হয়, তাহলে তা হবে প্রযুক্তি ইতিহাসের অন্যতম বড় এবং প্রভাবশালী চুক্তি, যা বিশ্বব্যাপী ওয়েব ব্রাউজিং অভিজ্ঞতাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।
এখন সবার নজর গুগল ও মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে। ২০শ শতাব্দীর শেষ ভাগে যেভাবে ইন্টারনেটের বিস্তার বৈশ্বিক যোগাযোগের ধারা পাল্টে দিয়েছিল, তেমনি ২১শ শতাব্দীর এই পর্যায়ে এআই প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত এমন এক বিশাল ব্যবসায়িক চুক্তি হয়তো ইন্টারনেট ব্যবহারের ভবিষ্যত ধারা নির্ধারণ করে দেবে। পারপ্লেক্সিটির মতো একটি তুলনামূলক নতুন কোম্পানি যদি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যবহৃত ব্রাউজারের মালিকানা অর্জন করে, তবে তা নিঃসন্দেহে প্রযুক্তি দুনিয়ায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।