নিউজ ডেস্ক: ভারতের অটোমোবাইল জগতে একসময় বিপ্লব ঘটিয়েছিল টাটা ন্যানো। বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা গাড়ি হিসেবে পরিচিত হলেও নানা কারণে সেই সময়ে প্রত্যাশিত সাফল্য পায়নি এই ছোট্ট হ্যাচব্যাক। তবে ২০২৫ সালে টাটা মোটরস আবারও ফিরিয়ে এনেছে ন্যানোর একেবারে নতুন সংস্করণ। নকশা থেকে শুরু করে প্রযুক্তি, নিরাপত্তা থেকে জ্বালানি দক্ষতা—সব ক্ষেত্রেই এই গাড়িটিকে আধুনিক সময়ের সঙ্গে মানানসই করে তোলা হয়েছে। মাত্র ৩.৫০ লক্ষ টাকা থেকে ৪.৩৫ লক্ষ টাকা (এক্স-শোরুম) দামের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে এই মডেল, যা মূলত প্রথমবার গাড়ি কিনতে ইচ্ছুক ক্রেতা, শিক্ষার্থী এবং সাশ্রয়ী পরিবারের জন্য লক্ষ্য করা হয়েছে। ফলে বাজেট গাড়ির প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এটি আবারও এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছে।
নতুন ন্যানো ২০২৫–এর নকশায় আনা হয়েছে একাধিক পরিবর্তন। ৩২০০ মিলিমিটার লম্বা, ১৫৫০ মিলিমিটার চওড়া ও ১৬৫০ মিলিমিটার উচ্চতার এই গাড়ির ওজন প্রায় ৭০০ থেকে ৭৫০ কেজি। হালকা কিন্তু শক্তিশালী স্টিল ফ্রেমে তৈরি হওয়ায় গাড়িটি যেমন টেকসই, তেমনি শহরের ভিড় রাস্তায় চালানোর জন্যও উপযুক্ত। ১৮০ মিলিমিটার গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স একে করে তুলেছে আরও কার্যকর, কারণ ভারতের অধিকাংশ শহরেই অসমান রাস্তায় এমন ক্লিয়ারেন্স প্রয়োজনীয়। IP54 জল ও ধুলোর প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকায় বর্ষার ভেজা রাস্তাতেও নিশ্চিন্তে ব্যবহার করা যায়। নতুন রঙের মধ্যে রয়েছে কসমিক ব্লু এবং ফায়ার রেড, যা ন্যানোকে দিয়েছে আরও প্রাণবন্ত চেহারা। LED হেডল্যাম্প, ১৪ ইঞ্চি অ্যালয় হুইল এবং চার আসনের লেআউট একে করেছে বাস্তবমুখী এবং আধুনিক শহুরে জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো।
ভেতরের দিকেও বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। গাড়িটিতে এখন রয়েছে ডিজিটাল ইন্সট্রুমেন্ট ক্লাস্টার ও ৭ ইঞ্চি টাচস্ক্রিন ইনফোটেইনমেন্ট সিস্টেম। এতে ব্লুটুথ কানেক্টিভিটি ও বেসিক ন্যাভিগেশন সাপোর্ট রয়েছে। শহুরে ড্রাইভিংয়ের জন্য সহজবোধ্য ইন্টারফেস ও ইনটুইটিভ কন্ট্রোল নতুন ব্যবহারকারীদের জন্য বিশেষভাবে আরামদায়ক। চারজন বসার মতো জায়গা থাকলেও, ন্যানোর আসল জোর এর ব্যবহারিক সুবিধায়। ছোট পরিবারের জন্য বা শিক্ষার্থীদের জন্য এটি যথেষ্ট কার্যকর একটি বিকল্প।
ইঞ্জিন ও পারফরম্যান্সের দিকে তাকালে দেখা যায়, ৬২৪ সিসি পেট্রোল ইঞ্জিন গাড়িটিকে শক্তি জোগাচ্ছে। এটি প্রায় ৩৮ বিএইচপি শক্তি উৎপন্ন করে ৫৫০০ আরপিএমে এবং ৪০০০ আরপিএমে ৫১ নিউটন মিটার টর্ক দেয়। ৫-স্পিড ম্যানুয়াল ও এএমটি ট্রান্সমিশন দুটি বিকল্পেই পাওয়া যাচ্ছে গাড়িটি। শহুরে যানজটপূর্ণ পরিবেশের জন্য উপযুক্ত এই ইঞ্জিন দাবি করছে ২৪ থেকে ২৫ কিমি প্রতি লিটার মাইলেজ, যা এই সেগমেন্টে সত্যিই প্রশংসনীয়। ২৪ লিটার ফুয়েল ট্যাঙ্ক থাকায় একবার ভরলে প্রায় ৫৭৬ থেকে ৬০০ কিমি পর্যন্ত চালানো সম্ভব। ফলে প্রতিদিনের ব্যবহারকারীদের জন্য এটি যথেষ্ট সুবিধাজনক। জ্বালানি খরচ হিসেব করলে প্রতি কিলোমিটারে গড় খরচ দাঁড়ায় প্রায় ২ থেকে ২.৫ টাকা, যা সত্যিই বাজেটসাশ্রয়ী।
গাড়িটির নিরাপত্তার দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন ন্যানোতে রয়েছে ডুয়াল এয়ারব্যাগ, এবিএস সহ ইবিডি সিস্টেম এবং রিয়ার পার্কিং সেন্সর। টপ ভ্যারিয়েন্টে যুক্ত হয়েছে রিয়ার পার্কিং ক্যামেরা, যা সংকীর্ণ জায়গায় গাড়ি ঘোরাতে বা পার্ক করতে সাহায্য করে। শহরের রাস্তায় যেখানে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি, সেখানে এই ফিচারগুলো চালকদের বাড়তি নিরাপত্তা দেয়।
ফিচার তালিকায় রয়েছে পাওয়ার উইন্ডো, পাওয়ার স্টিয়ারিং, সেন্ট্রাল লকিং সিস্টেম এবং এলইডি লাইটিং সাপোর্ট। ২-স্পিকারের অডিও সিস্টেম থাকলেও ৩.৫ মিমি জ্যাক নেই, ফলে ব্লুটুথ সংযোগই ভরসা। তবে এই দামের মধ্যে ফিচারগুলো বেশ সুষম বলেই মনে করছেন ব্যবহারকারীরা।
মূল্যের দিকে তাকালে দেখা যায়, টাটা ন্যানো ২০২৫ মডেলের বেস ভ্যারিয়েন্টের দাম রাখা হয়েছে ৩.৫০ লক্ষ টাকা এবং টপ ভ্যারিয়েন্টের দাম ৪.৩৫ লক্ষ টাকা (এক্স-শোরুম)। দিল্লিতে অন-রোড দাম দাঁড়াচ্ছে ৪ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ টাকার মধ্যে। এর মধ্যে রয়েছে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আরটিও চার্জ এবং ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা ইনস্যুরেন্স খরচ। মে ২০২৫ থেকে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে গাড়িটি, সঙ্গে রয়েছে আকর্ষণীয় অফার। ইএমআই স্কিম শুরু হচ্ছে মাসে মাত্র ৫২০০ টাকা থেকে, ফলে নিম্নমধ্যবিত্ত ক্রেতারাও সহজেই মালিক হতে পারবেন। মেইনটেন্যান্স খরচ অনুমান করা হচ্ছে বছরে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে, যা অন্য গাড়ির তুলনায় বেশ কম। বুকিংয়ের পর ডেলিভারি সময় লাগছে প্রায় ১৫ থেকে ৩০ দিন। ওয়ারেন্টি দেওয়া হচ্ছে ৩ বছর বা ৪৫,০০০ কিমি পর্যন্ত।
ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়ায় ইতিমধ্যেই উঠে এসেছে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক। অনেকে বলছেন, দামের তুলনায় মাইলেজ ও গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স যথেষ্ট ভালো। ১৮০ মিলিমিটার গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স ভারতের রাস্তায় চলার জন্য বড় সুবিধা এনে দিচ্ছে। আবার ২৫ কিমি প্রতি লিটার মাইলেজও ক্রেতাদের সন্তুষ্ট করেছে। ডিজাইনটিও আগের চেয়ে আধুনিক এবং আকর্ষণীয় হয়েছে বলে মন্তব্য করছেন অনেকে।
তবে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। ন্যানোর সর্বোচ্চ গতি এখনও সীমিত, ফলে দীর্ঘ হাইওয়ে যাত্রায় সমস্যা হতে পারে। ভেতরের ইন্টেরিয়র মান সাধারণ পর্যায়ের, যা অনেকের কাছে কিছুটা হতাশাজনক। এছাড়াও বুট স্পেস বা লাগেজ রাখার জায়গা খুবই সীমিত, ফলে দূরপাল্লার ভ্রমণে ব্যবহারকারীদের অসুবিধা হতে পারে।
প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে তুলনা করলে ন্যানো ২০২৫ অবশ্যই দামের দিক থেকে ও জ্বালানি সাশ্রয়ে এগিয়ে। ৩.৫০ লক্ষ থেকে ৪.৩৫ লক্ষ টাকার মধ্যে এই গাড়ি যেখানে পাওয়া যাচ্ছে, অন্য ব্র্যান্ডের গাড়িগুলো তুলনামূলকভাবে অনেক দামি। তবে শক্তি ও অভ্যন্তরীণ জায়গার দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে ন্যানো। বড় পরিবারের জন্য এটি উপযুক্ত নয়, কিন্তু শহুরে দৈনন্দিন ব্যবহারকারীদের জন্য যথেষ্ট কার্যকরী বিকল্প।
২০২৫ সালের মে মাসে লঞ্চ হওয়ার পর থেকেই গাড়িটি নিয়ে বাজারে নানা আলোচনা চলছে। যদিও কিছু তথ্য অনুমাননির্ভর, তবে গাড়ির ৬২৪ সিসি ইঞ্জিন, ২৫ কিমি প্রতি লিটার মাইলেজ ও ৩.৫০ থেকে ৪.৩৫ লক্ষ টাকার দাম নিশ্চিত। তাই ক্রেতাদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে কেনার আগে স্থানীয় ডিলারের সঙ্গে বিস্তারিত যাচাই করে নেওয়ার জন্য।
সবশেষে বলা যায়, টাটা ন্যানো ২০২৫ মডেল আবারও সাশ্রয়ী গাড়ির বাজারে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে। ৩২০০ মিলিমিটার লম্বা ফ্রেম, ৬২৪ সিসি ইঞ্জিন ও ২৫ কিমি প্রতি লিটার দক্ষতা একে করেছে শহুরে যাত্রী ও প্রথমবার গাড়ি কিনতে চাওয়া মানুষের কাছে এক দুর্দান্ত বিকল্প। যদিও শক্তি ও জায়গার দিক থেকে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবু টাটা মোটরসের শক্তিশালী সার্ভিস নেটওয়ার্ক ও ব্র্যান্ড আস্থা একে করেছে বাজেট সেগমেন্টের সেরা গাড়িগুলোর একটি। ছোট পরিবার কিংবা নতুন ক্রেতাদের জন্য ন্যানো ২০২৫ নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ চয়েস।